1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
  • E-paper
  • English Version
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০১ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

‘হাওর’: দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় বিশ্বস্ত সহযোগী

  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৯৪ বার পঠিত

এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ, করোনা অতিমারীর প্রভাব না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; বলতে গেলে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এই যুদ্ধ। সাথে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থা তো রয়েছেই। ফলে জ্বালানি এবং খাদ্যের মতো জরুরি পণ্যের উৎপাদন এবং রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি এবং ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। এখনই প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে বিশ্বে। বিশ্বব্যাংকের অক্টোবর মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এসব দেশের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং এশিয়া মহাদেশের ইয়েমেন ও আফগানিস্তানসহ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা আশঙ্কাজনক। এই দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ২০ কোটি মানুষ অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। বাংলাদেশেও বর্তমান দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ যার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি হতদরিদ্র। খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহ চেইনে সমস্যা হওয়ায় গোটা বিশ্বে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এখন। এর সাথে যোগ হচ্ছে ডলারের কারসাজি। সুতরাং এই সঙ্কট মোকাবেলায় স্থলভাগের সাথে বিশ হাজার বর্গমাইলের হাওরের অবদান অপরিহার্য।

আগেই বলেছি, বিশ্বের এই বেসামাল অর্থনৈতিক দুরবস্থা শিগগিরই কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা দীর্ঘমেয়াদে দুর্ভিক্ষে রূপ নিতে পারে। এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলায় উৎপাদনের সম্ভাব্য সব ক্ষেত্র, বিশেষ করে কৃষি, মৎস্য, পশুসম্পদ ইত্যাদি সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়ে খাদ্য সম্পদ বাড়াতে হবে। প্রতি ইঞ্চি জমি এবং পানিসম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। দেশের বিশাল হাওর সম্পদ হতে পারে চলতি এবং সম্ভাব্য বেসামাল অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য সহযোগী। আজকের আলোচনা মূলত হাওর অর্থনীতি চলতি অর্থনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে সেই বিষয় নিয়েই।

বাংলাদেশে হাওর
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা নিয়ে এই হাওর, যার আয়তন প্রায় ২০,০২২ বর্গ কিমি। এর বেশির ভাগ এলাকা ৬-৭ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। হাওর স্থায়ী জলাশয় নয়, বর্ষায় যেখানে শুধুই পানি, শুষ্ক মৌসুমে চোখ জুড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত আর ঘাসের চট্টন। বাংলাদেশে প্রায় আট লাখ ষাট হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে ৩৭৩টি হাওর রয়েছে যেখানে ২০ মিলিয়ন লোক বাস করে। যেখানে প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগনোর আহ্বান, সেখানে এত বড় হাওরকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব।

হাওর পরিবেশ, জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগৎ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য মূল্যবান। এগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। হাওর কৃষক, জেলে এবং নৌকাচালকের মতো বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত লাখ মানুষের জীবিকাকে সমর্থন করে। এটি মাছের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির আধার। তাছাড়া হাওর অঞ্চলে এ পর্যন্ত দেশের একমাত্র অপরিশোধিত তেলের খনির আধার।

এই সমৃদ্ধ হাওরে রয়েছে বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সম্পদ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বহুবিধ বিপদের সম্মুখীন। এর ফলে প্রতিযোগী সম্পদ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সহিংস দ্ব›দ্ব, দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক সঙ্কট হতে পারে। তবে উপযুক্ত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এই এলাকার সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলোর সম্ভাব্য সমাধানসহ নিচে আলোচনা করা হলো।

হাওরের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ
হাওরের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ বেকার এবং ৩৮ শতাংশ নিরক্ষর। ফলে বৈচিত্র্যময় সম্পদ থাকা সত্তে¡ও হাওর অনেক উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে সীমিত। বন্যার বার্ষিক চক্রের সাথে অনেক সময় নিষ্ফলা ঋতু দীর্ঘ হয়, যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। এক দিকে সীমিত সম্পদ অন্য দিকে বিকল্প সুযোগের অভাবে দরিদ্র মানুষগুলো রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত এবং প্রভাবশালী পরিবারগুলোর কাছে ফসলহীন সময়ের অভাব মিটানোর জন্য উচ্চ সুদের ঋণ গ্রহণ করে, ফলে তারা ঋণের জ্বালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে সময়ের পরিবর্তনে মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সচেতনতা বাড়ছে। সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় হাওর উন্নয়নের বিষয়কে জোরালোভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করে, হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, মৎস্য অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে হাওর রক্ষায় করার উদ্যোগ নিয়েছে।

হাওরবাসী বংশপরম্পরায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকে। অসময়ে বন্যা, অতিখরা, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কালবোশেখি ঝড় আর ছয় মাস অথই পানির বিনাশী ঢেউয়ের তাণ্ডবলীলার সাথে হাওরবাসীর যুদ্ধ যেন নিয়তির লিখন। বাকি ছয় মাস শুকনা; এমন প্রাকৃতিক নিয়মের ছকে বাঁধা হাওরবাসীর জীবনচক্র। কখনো পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টিতে এবং শিলাবৃষ্টির কারণে ফসল হারায়। বন্যা মৌসুমে হাওরের জলাশয়জুড়ে দমকা বাতাস এবং উচ্চ জলতরঙ্গের প্রভাবে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়। পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মৌলিক পরিষেবাগুলোতে ‘অ্যাক্সেস’ সীমিত হয়ে পরে তখন। প্রতিবেশী দেশের ভারী বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যার কারণে এই বন্যা; তাই পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কাছে আপিল করতে পারে এই বিষয়ে। হাওর ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা (এনআরএম) প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয়দের জ্ঞানও কাজে লাগানো যেতে পারে।

হাওরের অধিবাসী নারীরা বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গ বৈষম্যের সম্মুখীন হয়, যেমন, ভারী কাজের চাপ, উচ্চ স্তরের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টিকর খাদ্য যা মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার অ্যাক্সেসকে সীমিত করে, ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর উচ্চ মাত্রায় এটা প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে, সেখানকার নারীরা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অপুষ্টি এবং উচ্চ মাতৃমৃত্যুর হারের সম্মুখীন; ফলে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে না নারীরা।

চারণভূমিকে ধান চাষে রূপান্তরিত করা, বসতি এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধির ফলে গোচারণ ভূমি কমে যাওয়ার ফলে গোখাদ্য কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত রোগ বৃদ্ধির কারণে হাওর অঞ্চলে গবাদিপশু পালন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এক সময় প্রচুর বন ছিল যা বন্যপ্রাণী ও পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল ছিল, কিন্তু এখন বিলুপ্ত প্রায়। হাওর ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ জমিতে বনায়ন আইন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। প্রায় ১৫ বছর আগে ইউএনডিপির উদ্যোগে উপকূলীয় জলাভূমি এবং জীববৈচিত্র্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অধীনে অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয়েছিল সেই গবেষণাটি আবার করা প্রয়োজন।

হাওর থেকে দেশের মৎস্যের শতকরা ২৫ ভাগ আহরণ করা হয়। এখানে প্রায় ১২৭,৪৮২ হেক্টর মৎস্য চাষের এলাকা রয়েছে যেখানে প্রতি বছর ৫৭,১৯৯ টন মাছ উৎপাদন হয়। দেশীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অনেক মাছ এখনো হাওরে টিকে আছে। এখানে মিঠাপানির মাছ আছে ১৫০ প্রজাতির। তাই হাওর অঞ্চলকে দারিদ্র্য ও দুর্যোগের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করতে এ খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধান চাষে কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার জমির গুণাগুণ নষ্ট করছে যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে বেশির ভাগ পাখি ও মাছের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। হাওরের খাস জমিতে গড়ে উঠছে অবৈধ মাছের খামার এবং এতে মাছের স্বাভাবিক চলাচলের পাশাপাশি প্রজননেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাই ব্যক্তিবিশেষের পরিবর্তে সামাজিক সংগঠনকে ইজারা প্রদান এবং জলাশয়ের বিধিমালা সংশোধনের মাধ্যমে সব পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকার স্বার্থান্বেষী মৎস্যজীবী ও কৃষকদের দ্বন্দ্ব নিরসনে জলাশয় ব্যবস্থাপনার জন্য ‘জল যার, জলা তার’ নীতির উদ্যোগ নিয়েছে যা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

হাওর অঞ্চল এক ফসলি এলাকা। বোরো ধান চাষ এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এখানে ৭১০,০০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫.৩ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়, যা জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ এবং গড়ে জাতীয় জিডিপির ৬.৮ শতাংশ। এখানে স্বল্পমেয়াদি ধান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে এবং যান্ত্রিক চাষ অনুসরণ করে বন্যার আগাম প্রভাব এড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রচেষ্টা কৃষকদের সরিষার মতো খুব অল্প সময়ের রবি ফসল চাষে সহায়তা করবে। হাওর মহাপরিকল্পনায় অনেক প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে, যা কার্যকর হলে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। স্থানীয় সরকার ফসল চাষের জন্য কৃষকদের সুদমুক্ত/স্বল্প সুদে ঋণ দিতে পারে। বাণিজ্যিক কৃষিকে উন্নীত করলে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। ফলে মানবসম্পদের অত্যধিক ব্যবহার হবে।

হাওর অঞ্চলের ৮৯ শতাংশ পরিবারকে গড়ে ৬.৪ মাসের খাদ্য সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়। এখানে পানীয় জলের উৎস খুবই কম এবং অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক দ্বারা দূষিত। এই অঞ্চলের প্রায় ৬৭ শতাংশ পরিবার এখনো খোলা জলাশয়ের পানিতে ধোয়া-মোছার জন্য পানি সংগ্রহ করে যে পানির বেশির ভাগই রোগজীবাণু পূর্ণ। ফলে অধিকাংশ পরিবারে জলবাহিত রোগের প্রভাব দেখা যায়। এতে মা ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা পুষ্টিহীনতা এবং স্বাস্থ্যহীনতার কবলে পড়ে।

হাওর প্রকৃতির অপরূপ লীলানিকেতন, ফলে প্রতিটা ক্ষণ উপভোগ্য। বৈশাখের ফসল তোলার মৌসুমে প্রকৃতির নতুন রূপ, হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যস্ততা প্রকৃতিবান্ধব সারল্যে ভরপুর। শীতে কুয়াশাচ্ছন্ন হাওরের অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ। বর্ষায় হাওরের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতোন বাড়িঘরগুলো অপূর্ব সুন্দর লাগে। শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের মায়াবতী দৃশ্য কিংবা বিকেলের স্নিগ্ধতায় দূরের পাহাড়ের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য, সব কিছুকে বিধাতা যেন অঢেল অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন। বিশাল এই হাওরকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটনশিল্প সমৃদ্ধ হতে পারে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সমাগমে।

হাওর এলাকায় বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা কাজ করছে। কখনো কখনো, একটি সংস্থার উদ্যোগ অন্য সংস্থার কাছে অজানা থেকে যায়, অনেক সময় এক সংস্থার নির্মাণ প্রকল্প কখনো কখনো অন্য সংস্থার বাধার সম্মুখীন হয়। ফলস্বরূপ একই প্রচেষ্টা একাধিক প্রতিষ্ঠানকে করতে দেখা যায়, ফলে সম্পদের অপচয় হয়। সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সমন্বয় করা প্রয়োজন।

হাওর দেশের এক-পঞ্চমাংশ ধান উৎপাদন করে সারা দেশের মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশের কৃষি-অর্থনীতিতে। বছরে একটিমাত্র ফসল হলেও বছরে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে হাওর। দুঃখ কিংবা গর্ব যাই হোক, বলা হয়ে থাকে- এক ফসলি ধান; হাওরবাসীর প্রাণ। বিরল বিচিত্র দেশী জাতের অনেক ধান এখনো এ হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওর অঞ্চলের জলাবদ্ধ এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব।

হাওরের উন্নয়নে পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন
বাংলাদেশে সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাওরাঞ্চলের অনবদ্য অবদান ও ভূমিকার জন্য আগামী দিনের খাদ্য ও মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে হাওরাঞ্চলকে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। বিশালাকার এই প্রাকৃতিক পললভূমির জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি হলেও গুরুত্ব অনুধাবনের অবহেলায় আজো একটি ‘হাওরবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠিত হয়নি। পাহাড়ের পলিবাহিত পানিকে হাওরের শত্রু না ভেবে অকাল বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষায় উৎপাদন সময় কমিয়ে বা এগিয়ে আনার কথা ভাবতে হবে। কম সময়ে উন্নত জাতের অধিক ফলনশীল ধান চাষ করা দরকার। চীনের দুঃখ হোয়াংহু নদী আর হাওরবাসীর দুঃখ বাঁধ। বাঁধগুলোকে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের নেতৃত্বে স্থায়ীভাবে নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। মেঘালয় থেকে আগত ঢলের পানি যে স্থানটিতে প্রথমে এসে পড়ে সেখানটায় মাটি খনন করে জলাধার বানাতে হবে। তাহলে প্রথমেই পানির ঢল এসে সেখানে জমা হবে এবং পানির প্রবাহে চাপ কমবে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, ডোবা, খন্তাগুলো খনন এবং অকাল বন্যারোধী বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে নির্মাণ করলে হাওরের ৮০ ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পেছনে হাওরবাসীর অনন্য অবদান রয়েছে। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ৩০-৩৫ শতাংশ মাছের সরবরাহ আসে এই হাওরের পাললিক জলাশয় থেকে। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনেক দিন হাওর ছিল দৃষ্টির আড়ালে। ইদানীং হাওর নিয়ে একটি আশাবাদের জায়গা তৈরি হয়েছে। হাওরবাসীর প্রত্যাশা, সমন্বিত ও পরিকল্পিত উপায়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ১০ বছরে পাল্টে যাবে হাওরের অর্থনৈতিক চেহারা। হাওরাঞ্চলের কিশোরী ও নারীদের কর্মমুখী করার জন্য হাঁস, মুরগি, কবুতরসহ গৃহপালিত পশু পালনসহ হস্ত ও কুটিরশিল্প খাতে নারীদের নিয়োজিত করা যেতে পারে। ধান, মাছ, গবাদিপশু, পাখি, জলজ প্রাণী, জীববৈচিত্র্য, পর্যটন, কালোমাটি, জ্বালানি কাঠ, বালি, পাথর, মুক্তাসহ আরো অনেক অজানা সম্পদ লুকিয়ে আছে হাওরের মাটির নিচে। শুকনা সময়ে পতিত ‘চট্টন’ এলাকাকে কী করে উৎপাদনশীল হিসেবে তৈরি করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। মোটকথা প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিলে হাওরের প্রকৃত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত এলাকাজুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে লুক্কায়িত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে কাজে লাগালে দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..